সিলেট আলাপ ডেস্ক :ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। ওয়াসিফের ঘুমানোর সময়। সে ভাবল যাই ফেসবুকে একটু ঢুঁ মেরে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ। মুহূর্তেই সে হারিয়ে গেল ফেসবুকের রঙিন দুনিয়ায়। হঠাৎ করেই সে লক্ষ্য করে রাত প্রায় ১টা বাজতে চলেছে। এ যেন আজকের তরুণ সমাজের প্রতিদিনের চিত্র। বর্তমানে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন চেক করে সকাল শুরু হয় বেশির ভাগ মানুষের। রাতে ঘুমাতে গেলেও একই কাজ। এককথায় আমাদের পুরো জীবনটা এখন আটকে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারাগারে। অসংখ্য নোটিফিকেশন এবং অপ্রয়োজনীয় ভিডিওর একটি অসীম গোলকধাঁধায় আটকে গেছি আমরা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, গত জুন, ২০২৪ মাস শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রধানতম সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলি হল Facebook, YouTube, Instagram, Twitter, Snapchat এবং LinkedIn।
আমেরিকান সোসাইটি অব অ্যাডিকশন মেডিসিন সংস্থার বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদনে বলা হয়, আসক্তি হচ্ছে এমন এক আচরণ, যার নেতিবাচক পরিণতি সত্ত্বেও মানুষ তাতে প্রতিনিয়ত অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে এটা শতভাগ সত্য। আজকের পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে জীবনগ্রাসী মাদকাসক্তির সঙ্গে। শিশু এবং বিশেষ করে তরুণ সমাজ এর দারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর নেতিবাচক বলয় থেকে নিরাপদ নয় কেউই। শিক্ষাগ্রহণের এই বয়সে সারাক্ষণ ফেসবুকের নেশায় বুদ হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। FOMO অর্থাৎ হারিয়ে যাওয়ার ভয়, যারা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো সাইটগুলো ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে এই ভয় বেশি সৃষ্টি হয়। তাদের মনে হয় তারা কিছু মিস করে যাচ্ছেন, একটা উদ্বেগ তৈরি হয়, এতে আরও বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ইচ্ছা জাগে। গবেষণা বলছে, এই ফোমো অর্থাৎ হারিয়ে যাওয়ার ভয় কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর আপনাকে বিভিন্ন আপডেট জানতে ফোন ব্যবহারে বাধ্য করে।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি কেন আমাদের এই আসক্তি? এর সুন্দর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণত একটি তাৎক্ষণিক ডোপামিনের প্রবাহ দেয় এবং আমাদের উচ্ছ্বসিত অনুভব করায়। ডোপামিন হচ্ছে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার যেটি আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। সহজ কথায় , আমাদের শরীরে আনন্দের অনুভূতি যোগান দেয় ডোপামিন হরমোন। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শুরুর সময় যে উচ্ছ্বাস বা আনন্দ আমরা অনুভব করি, সেই একই অনুভূতি পেতে আমাদের প্রতিদিন আরও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়, কারণ আমাদের দেহ দ্রুত কৃত্রিম ডোপামিন প্রবাহের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে, দেহ কৃত্রিম উত্তেজনার জন্য আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে এবং ব্যক্তি আরও বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করতে থাকে, যার ফলে ভিত্তি আরোহণ করে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য আরো আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় সেই ভিত্তি অতিক্রম করার জন্য। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রামের বেশি ব্যবহার একাকিত্বের অনুভূতি হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি প্রাধান্য দিলে উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক ব্যাধিগুলো নিজের অজান্তেই বেড়ে চলে। এ ছাড়া গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়।
তবে এটা সত্য যে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে অনেক দিক থেকে উন্নত করেছে। এর প্রথম এবং মূল সুবিধা হচ্ছে কানেক্টিভিটি। মানুষ আজ যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে। কোনো স্থান বা ধর্ম বাধা হতে পারে না। কিন্তু চিন্তার কারন হচ্ছে এর মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ার মায়াজাল থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে? আগে আপনার নিজেকে বোঝাতে হবে যে, কেন আপনি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে চান। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমানোর ফলে আপনার কি কি সুবিধা হবে, সেটা নিজেকে বোঝান। যেমন, আপনি হয়তো নিজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি বা মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করার উদ্দেশ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে চান। নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তাই অন্যান্য শখের কাজের প্রতি মনোযোগ দিন। বই পড়া, শখের বাগান করা বা অন্য কোনও শখের কাজ থাকলে সেটা নিয়ে সময় কাটান। বেশির ভাগ মানুষই অবচেতনভাবেই ক্রমাগত সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারেন। এ ক্ষেত্রে অ্যাপ মুছে ফেলা বা সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিলে একজন ব্যবহারকারীর আসক্তি কমে যেতে পারে । কারণ, মোবাইল স্ক্রিনে চোখ পড়লে সোশ্যাল মিডিয়া আইকন দেখা না গেলে স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা যাবে।
চেষ্টা করুন বন্ধুদের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করে আড্ডা দিতে। আড্ডার সময় ফোন ব্যবহার করবেন না, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করবেন প্রয়োজন ছাড়া ফোন ব্যবহার না করার জন্য। পরিবারের সঙ্গেও সময় কাটান। একসঙ্গে রাতের খাবার খান, নির্মল আড্ডা দিন। এই সময় হাতের কাছে স্মার্টফোন রাখবেন না। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, গয়না, গ্যাজেট বা অনলাইন কেনাকাটার সাইটগুলোর পেইজ লাইক করবেন না। অযথা বিজ্ঞাপন আসলে সেগুলো হাইড করে দিন। অন্যথায় এই সাইটগুলির এলগোরিদম আপনার সোশ্যাল মিডিয়া ফিডে এই ধরনের সংবাদ অনবরত যোগান দিতে থাকবে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিন নিজেকেই। সেটা শুরুতেই অনেক বেশি সময়ের জন্য হতে হবে এমন নয়। শুরুতে একটি পুরো বেলা, এরপর একদিন এভাবে এগিয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য সময় নির্ধারণ করতে পারেন। এই সময় ভ্রমণে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। মনে রাখতে হবে, ‘প্রতিরোধ প্রতিষেধকের চেয়ে উত্তম’। প্রথম থেকেই শর্ত না দিলে পরবর্তীতে শর্তারোপ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা যতই থাকুক তবুও ছেলেমেয়েদের জন্য সেটির একটা রুটিন করে দেয়া অভিভাবকদেরই দায়িত্ব। অর্থাৎ কখন বা কতক্ষণ ব্যবহার করা যাবে, রাতে ও স্কুলের সময়ে ফোনটি কোথায় থাকবে, লক সিস্টেম বাবা-মা জানবে কিনা, কোন কোন অ্যাপ ব্যবহার করবে, অনিয়মের কি প্রতিফলন হবে ইত্যাদি বিষয় নির্দ্দিষ্ট করে শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেওয়া উচিত।
মিডিয়ার সাইটগুলোতে নানা ধরনের রেকমেনডেশন পাঠানোর জন্য যেসব প্রোগ্রাম দেয়া থাকে, সেগুলো শিশুদের বয়সোপযোগী না হওয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। অনেকে মানসিক অবসাদ কিংবা আত্মহত্যার জন্য তথ্য খুঁজলে তাও এসব রেকমেনডেশন ইঞ্জিনগুলো আরও বেশি করে তথ্য পাঠায়।
তাই পিতামাতাদের উচিত তাদের তরুণ ও কিশোর-কিশোরী সন্তানদের সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা এবং ব্যবহারের বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া। -পিআইডি ফিচার
খবর পেতে সিলেটের আলাপ লাইক পেইজে ( LIKE ) দিতে ক্লিক করুন
সিলেট আলাপ// পিনা